বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ১০:৪৪ অপরাহ্ন

জ্বালানি নিরাপত্তায় স্বল্পমেয়াদি মূল্য সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ

জ্বালানি নিরাপত্তায় স্বল্পমেয়াদি মূল্য সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ

আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রলিয়ামের দামের ওঠানামা এবং বিনিময় হারের তারতম্যের মধ্যে, বাংলাদেশ সরকার হঠাৎ ভোক্তাপর্যায়ে সমস্ত জ্বালানি তেলের খুচরা মূল্য বৃদ্ধি করেছে। এ বৃদ্ধির ফলে জ্বালানির দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের প্রভাবে বর্তমান বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাংলাদেশকে দামের পুনর্বিন্যাস করতে হয়েছে। এর আগে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশীদেরকে বিশ্ববাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হারে জ্বালানি তেল, গ্যাস এবং বিদ্যুতের জন্য বেশি মূল্য দিতে হতে পারে।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই খবর ছড়িয়ে পড়লে, নতুন দাম কার্যকর হওয়ার আগে জ্বালানি কেনার আশায় শত শত মানুষ সারা দেশের রিফুয়েলিং স্টেশনে ভিড় করেন; কিন্তু স্টেশন কর্তৃপক্ষ জ্বালানি বিক্রি বন্ধ করে দেয়ায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে আমরা হয়তো সহজেই বুঝতে পারি যে, অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার পথে ফিরিয়ে আনতে সরকারকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ‘জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি : আসন্ন প্রভাব’ শীর্ষক অনলাইনে আয়োজিত এক সেমিনারে জ্বালানি সচিব মো: আনিসুর রহমান অভিমত ব্যক্ত করেন যে, এই সিদ্ধান্ত না নিলে জ্বালানি আমদানির পরবর্তী চালান বন্ধ হয়ে যেত, যা তখন বড় ধরনের সঙ্কটের সৃষ্টি করত। গত ৪ আগস্ট ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে ব্যবসায়ীরা নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সর্বোচ্চ এ মূল্যবৃদ্ধি নিঃসন্দেহে আবারো মুদ্রাস্ফীতি ঘটাবে ও অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে, কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্কট এবং বিশ্ববাজারে উচ্চমূল্যের কারণে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হাতে দাম বৃদ্ধি ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। বৈশ্বিক তেল উৎপাদনে বিনিয়োগের হ্রাস, কোভিড-১৯ মহামারী থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্পর্কিত চাহিদা বৃদ্ধি এবং অবশেষে ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২-এ ইউক্রেনে রাশিয়ান আক্রমণের কারণে ২০২২ সালের মার্চ মাসে অপরিশোধিত তেল ব্যারেল-প্রতি ১৩০ মার্কিন ডলার বেড়ে গিয়েছিল। এপ্রিলে ব্যারেল-প্রতি ১০০ মার্কিন ডলারে কমে যাওয়ার আগে ২০০৮ সালের পর থেকে এ বৃদ্ধি সর্বোচ্চ ছিল।

এমতাবস্থায়, পেট্রলিয়াম পণ্যের দাম যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে বজায় রাখার ব্যাপারে সরকারের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অল্প সময়ের জন্য হলেও ভোক্তাদেরকে এর বোঝা বহন করতে হবে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের ঊর্ধ্বগতির প্রবণতা বিবেচনায় বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ নিয়মিত জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করছে। ভারতে জ্বালানির দাম বৈশ্বিক মূল্যের সাথে ওঠানামা করে যেখানে বাংলাদেশে জ্বালানির দাম প্রায় পাঁচ বছর ধরে (এপ্রিল ২০১৬-নভেম্বর ২০২১) স্থির রয়েছে, যদিও বিশ্বব্যাপী অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৮১.৬ থেকে ১১৮.৫ মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম কমার পর পেট্রলের দাম প্রতি লিটারে ১০ টাকা কমে ৮৬ টাকা এবং ডিজেলের দাম প্রতি লিটার থেকে ৩ টাকা থেকে ৬৫ টাকা কমিয়েছিল সরকার।

অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বাংলাদেশে দাম কম থাকায় হাজার হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল সীমান্ত দিয়ে পাচার হচ্ছিল। সে কারণেই বাংলাদেশ যদি পেট্রলিয়াম জ্বালানির দাম সমন্বয় না করে, তাহলে প্রতিবেশী দেশগুলোতে জ্বালানি পাচারের ঝুঁকি রয়েছে, কারণ ভারত ও মিয়ানমারে পেট্রল ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। দাম বৃদ্ধির আগে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে পেট্রল ও ডিজেলের দাম ছিল ৩৪.০৯ টাকা এবং ৪৪.৪২ টাকা কম। দামের এই পার্থক্যের কারণে সীমান্ত দিয়ে জ্বালানি পাচার হতে পারে। তা ছাড়া চোরাচালানের ফলে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে যার ফলে সাধারণ মানুষ সঠিক পরিমাণ জ্বালানি তেল থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তাই সাম্প্রতিক জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের ফলে জ্বালানি পাচার বন্ধ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বৃহত্তর অর্থে যেখানে প্রতিটি পয়সা গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বিশ্ববাজারে এ সমন্বয় অপরিহার্য। কম দামে জ্বালানি বিক্রি করে ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৮০ হাজার কোটি টাকা লোকসানের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বলা হয়ে থাকে যে, যখনই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭০ মার্কিন ডলারের উপরে উঠে তখন সরকার ক্ষতির সম্মুখীন হয় কারণ জীবনযাত্রার খরচ কম রাখতে ভর্তুকি দিতে হয় সরকারকে।

উল্লেখ্য, গত সোমবার পর্যন্ত এ অঞ্চলে সবচেয়ে কম পেট্রলিয়ামের দাম ছিল বাংলাদেশে। কারণ, প্রতিবেশী দেশগুলো জ্বালানি খাতে বেশি ভর্তুকি না দেয়ায় এবং জ্বালানির দাম বাড়ালেও বাংলাদেশ গত বছর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ছয় বিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিয়েছে এবং বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে জ্বালানিকে। যাই হোক, বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির বিতর্কটি ভালোভাবে বুঝতে প্রতিবেশী দেশ বা অঞ্চলের দামের দিকে তাকানো যেতে পারে।

ভারত জ্বালানি তেলের প্রায় ৮৫ শতাংশ আমদানি করে। ভারতীয় পেট্রলিয়াম শিল্প অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় অনেক বড় এবং উন্নত এবং দেশটি রাশিয়া থেকে ৩০ শতাংশ সস্তা অপরিশোধিত তেল পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অপরিশোধিত তেলের দাম এবং ডলার/রুপির বিনিময় হার জ্বালানি তেলের দামকে প্রভাবিত করে। নয়া দিল্লির থিংকট্যাংক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, মার্চ ২০১৪ থেকে অক্টোবর ২০২১ এর মধ্যে, ভারত সরকার কর্তৃক পেট্রলের ওপর আরোপিত কর ২০০ শতাংশের বেশি এবং ডিজেলের ওপর ৬০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। নয়াদিল্লিতে পেট্রল এবং ডিজেলের দাম দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১২০.৫১ টাকা এবং ১০৪.৭৭ টাকা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ দীর্ঘ দিন ধরে যুক্তিসঙ্গত আমদানি কর বজায় রেখেছে যদিও এগুলো সরকারের রাজস্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার মতো ঋণগ্রস্ত দেশগুলো ইতোমধ্যে তেলের উচ্চমূল্যের প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছে। পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ জ্বালানির ভর্তুকি বাদ দিয়েছেন এবং পেট্রলিয়ামের দাম প্রতি লিটারে ২৪৮.৭৪ রুপি এবং ডিজেলের জন্য ২৭৬.৫৪ রুপি নির্ধারণ করেছেন। ১-১.৫ মাসের মধ্যে পাকিস্তানে এটি চতুর্থবারের মতো পেট্রলিয়ামের দাম বৃদ্ধি। সঙ্কটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা প্রতি লিটার পেট্রলের জন্য এই অঞ্চলে সর্বোচ্চ মূল্য (টাকা ১৪৩.৫১) ধার্য করছে যেখানে নেপালিরা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মূল্য পরিশোধ করছে (১৩৬.২৭ টাকা)।

এরকম একটি বিরূপ পরিস্থিতিতে, উন্নয়নশীল দেশের বেশির ভাগ সরকারের কাছে দাম বৃদ্ধি ছাড়া খুব কম বিকল্প রয়েছে। যাই হোক, ২২ জুলাই রেমিট্যান্স ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয়ায় এবং বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় টাকা শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

যদিও প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার তুলনায় পেট্রলের নতুন দাম এখনো কম, তবুও আমাদের এই সত্যটি মেনে নিতে হবে যে, অতিরিক্ত জ্বালানির দামে নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বেড়ে যাবে, যারা ইতোমধ্যে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সাথে লড়াই করে চলেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সত্য যে, মূল্য সমন্বয় একটি যৌক্তিক এবং যুক্তিসঙ্গত বিষয়। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সরকারের দাম পুনর্বিবেচনা করা উচিত। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে সরকার শুল্ক কমিয়ে দিলে মানুষ কোনো প্রশ্ন তুলবে না। একইভাবে, কেউ যদি কৃত্রিম জ্বালানি সঙ্কট তৈরি করে বা উচ্চমূল্যে জ্বালানি বিক্রি করে তাহলে সরকারকে অবশ্যই কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে এই ধরনের দাম বৃদ্ধির প্রভাব থেকে দরিদ্রদের রক্ষা করা যায়।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877